বিস্তারিত - আরশের নিচে ছায়া সংক্রান্ত হাদিস আল্লাহর ছায়া
আজ এই আলোচনার মাধ্যমে জানতে পারবো আরশের নিচে ছায়া সংক্রান্ত হাদিস অর্থাৎ হাশরের ময়দানে কে কে আল্লাহর ছায়া পাবেন। হাশরের ময়দান এমন এক জায়গা যেটা কারো জন্য অনেক শান্তির আবার কারো জন্য সীমাহীন কষ্টের।
যারা মহান আল্লাহর ছায়া অর্থাৎ আরশের নিচে ছায়া পাবেন তারা তো অনেক আনন্দপুর্ন সময় কাটাবেন। আর যারা আল্লাহর ছায়া তথা আরশের নিচে ছায়া পাবে না তাদের জন্য এমন কষ্টের হবে যা কোন মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না।
পেজ সূচিপত্র: বিস্তারিত - আরশের নিচে ছায়া সংক্রান্ত হাদিস আল্লাহর ছায়া
- আরশের নিচে ছায়া সংক্রান্ত হাদিস - হাশরের ময়দানে আরশের ছায়া প্রাপ্ত মু'মিনগণ
- আবু হুরায়রাহ (রা.) এর জীবন পরিক্রমা - বিড়াল নিয়ে হাদিস
- হাদীসের উৎস বিশ্লেষণ
- হাদীসটির আলোচ্য বিষয় ও এর গুরুত্ব
- আল্লাহর ছায়া
- আলোচ্য হাদীস "আরশের নিচে ছায়া সংক্রান্ত হাদিস" এর ব্যাখ্যা
- কেমন হবে হাশরের ময়দানের অবস্থা - কঠিন হাশরের দিনে যা হবে
- ক. হাশর দিবসে সূর্য মাথার সামান্য উপরে নেমে আসবে:
- খ. হাশরের মাঠের ভয়াবহতা, মৃত্যু ও কবরের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি হবে:
- গ. প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের চিন্তায় মগ্ন থাকবে:
- ঘ. হাশরের দিনটি দুনিয়ার পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান:
- হাশরের ময়দানে আরশের ছায়া প্রাপ্ত সাত শ্রেণির ব্যক্তি
- এক. ন্যায়পরায়ণ বাদশা বা শাসকঃ
- দুই. যে যুবক তার যৌবনকাল আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়েছে
- তিন. এমন মুসলিম যার অন্তর মসজিদের সাথে ঝুলন্ত থাকে
- চার. আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় পরস্পরকে ভালোবাসা
- পাঁচ. অশ্লীলতা থেকে চরিত্রের হিফাযত
- ছয়. গোপনে দান করা - গোপনে দান করার ফজিলত
- সাত. নির্জনে আল্লাহর ভয়ে চোখের পানি ফেলে
- হাদীসটির শিক্ষণীয় দিক
আলোচনার ধারাবাহিকতা হল প্রথমে হাদিস তারপরে হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবী আবু হুরায়রাহ (রা.)-এর জীবন পরিক্রমা তার পরে হাদীসের উৎস বিশ্লেষণ, হাদীসটির আলোচ্য বিষয় ও এর গুরুত্ব এবং তার পরে হাদিসের ব্যাখ্যা। তাহলে চলুন জেনে নেই আরশের নিচে ছায়া সংক্রান্ত হাদিস।
আরশের নিচে ছায়া সংক্রান্ত হাদিস - হাশরের ময়দানে আরশের ছায়া প্রাপ্ত মু'মিনগণ
আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী করীম (স.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসুল (স.) বলেছেন, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলা সাত শ্রেণির ব্যক্তিকে তাঁর আরশের ছায়া দান করবেন, যেদিন ঐ ছায়া ব্যতীত আর কোনো ছায়া থাকবে না। সেই সাত শ্রেণীর সৌভাগ্যবান হাশরের ময়দানে আরশের ছায়া প্রাপ্ত মু'মিনগণ হলেন
প্রথম: ন্যায়পরায়ণ শাসক।
দ্বিতীয়: ঐ যুবক, যে আল্লাহ ইবাদতে বেড়ে উঠে।
তৃতীয়: ঐ ব্যক্তি, যার অন্তর মসজিদের সাথে ঝুলন্ত থাকে।
চতুর্থ: এমন দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই পরস্পরকে ভালোবাসে। আবার আল্লাহর জন্য তারা মিলিত হয় এবং আল্লাহর জন্য পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়।
পঞ্চম: এমন ব্যক্তি, যাকে অভিজাত বংশীয় কোনো সুন্দরী রমণী কুকর্মের জন্য ডাকে। আর সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি।
ছষ্ঠ: ঐ ব্যক্তি, যে গোপনে দান করে, এমনকি তার ডান হাত দ্বারা কী দান করল, বাম হাত তা টের পায় না।
সপ্তম: ঐ ব্যক্তি, যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার দু'চোখের অশ্রু ঝরায়।
আবু হুরায়রাহ (রা.) এর জীবন পরিক্রমা - বিড়াল নিয়ে হাদিস
রাসূলুল্লাহ (স.) এর অন্যতম সহচর এবং প্রখ্যাত সাহাবী এবং হাদীস বর্ণনাকারী হযরত আবূ হুরায়রাহ (রা)-এর ইসলামপূর্ব যুগে নাম ছিল 'আবদুশ শামস্'। ইসলাম গ্রহণের পর আল্লাহর রাসূল (স.) তাঁর নাম রাখেন 'আবদুর রহমান'।
তিনি শিশু কালে প্রায়ই বিড়ালছানা নিয়ে খেলা করতেন। রাসূলুল্লাহ (স.) কোনো কোনো সময় তাকে আদর করে আবূ হুরায়রাহ (বিড়াল শাবকওয়ালা) বলে ডাকতেন। তাই পরবর্তীতে তিনি এ নামেই পরিচিত হয়ে উঠেন।
তাঁর পিতার নাম সাখর আর মাতার নাম উমাইয়া দাওস গোত্রের সন্তান বলে তাঁকে আবূ হুরায়রাহ আদ-দাওসি নামেও অভিহিত করা হয়। ত্রিশ বছরের যুবক আবূ হুরায়রাহ (রা.) ৬২৯ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক সপ্তম হিজরীতে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন।
তিনি ইসলাম গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহ (স.)-এর একান্ত সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন। আসহাবে সুফফার সদস্য হিসেবে মসজিদে নববীকেই নিজের আশ্রয়স্থল ও রাসূলুল্লাহ (স.)-কে তাঁর শিক্ষক হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
রাসূল (স.)-এর নিকট হতে যত হাদীস শোনার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছে অন্য কোনো সাহাবীর তা হয়নি। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৫৩৭৪টি। তন্মোধ্যে সহীহ বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্থে স্থান পেয়েছে মোট ৩২৫টি। এককভাবে বুখারীতে রয়েছে ৭৯টি এবং মুসলিমে ৭৩টি হাদীস।
ইমাম বুখারী (রহ.) বলেন, 'আটশর বেশি সাহাবী ও তাবিঈ তাঁর নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। সাহাবীদের মধ্যে যারা তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন তাদের মধ্যে ইবন আব্বাস, ইবন উমার, জাবির, আনাস, ওয়াসিলা (রা) প্রমুখ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
খলিফা হযরত ওমর (রা) আবূ হুরায়রাহ (রা)-কে বাহরাইনের শাসক নিযুক্ত করেছিলেন। হযরত মুয়াবিয়া (রা)-এর শাসনামলে তিনি মদিনার শাসক নিযুক্ত হয়েছিলেন। আবূ হুরায়রাহ (রা) ৭৮ বছর বয়সে মদীনার অদূরে 'কারা' নামক স্থানে ৫৫ অথবা ৫৭ অথবা ৫৯ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।
হাদীসের উৎস বিশ্লেষণ
সহীহুল বুখারী, সহীহ মুসলিম, জামিউত তিরমিযী, মুয়াত্তা ইমাম মালিক, মুসনাদু আহমদসহ বিভিন্ন প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থে এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে, ইমাম তিরমিযী (রহ.) এ হাদীসটিকে হাসান ও সহীহ বলেছেন। এছাড়া নাসির উদ্দীন আলবানীও (রহ.) এ হাদীসটিকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
হাদীসটির আলোচ্য বিষয় ও এর গুরুত্ব
মু'মিন হিসাবে আমরা প্রত্যেকেই তিনটি জিনিস চাই।
১. আল্লাহর সন্তুষ্টি
2. দুনিয়ার কল্যাণ ও
৩. আখিরাতে নিয়ামতপূর্ণ জান্নাত।
অত্র হাদীসে এমন সাতটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে যা যথার্থভাবে আদায় করতে পারলে আমরা উপরে উল্লেখিত তিনটি বিষয়ই লাভ করতে পারব।
হাশরের ময়দানে সকল মানুষ যখন বিচারের জন্য সমবেত হবে, তখন তাদের মাথার উপর সূর্য থাকবে খুবই কাছাকাছি। মহান আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়ার ব্যবস্থা থাকবে না। তখন মানুষ একটু ছায়ার সন্ধানে বিভিন্ন দিকে ছোটাছুটি করবে। এমতাবস্থায় সাত শ্রেণির লোককে মহান আল্লাহ তাঁর রহমতের ছায়া দান করবেন।
বর্তমানে সমাজ জীবনে যে বিশৃঙ্খলা, হানাহানি, যুলুম, নির্যাতন, নিরাপত্তাহীনতা, অশান্তি বিরাজ করছে তা থেকে রক্ষা পাবার জন্য অত্র হাদীসে বর্ণিত সাতটি বিষয়ের বাস্তবায়ন অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এ মাধ্যমে অর্জিত হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন হবে নিরাপদ ও পরকালীন জীবন হবে শান্তিপূর্ণ।
আল্লাহর ছায়া
আল্লাহর ছায়া বলতে সেই বিচার দিবসের কঠিন মূহূর্তে যখন কোনো ছায়া থাকবে না তখন কেবল মহান আল্লাহর পবিত্র আরশের ছায়া থাকবে এবং যারা মহান আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারা সেই আরশের নিচে ছায়া পাবেন।
আলোচ্য হাদীস "আরশের নিচে ছায়া সংক্রান্ত হাদিস" এর ব্যাখ্যা
রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন
سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللهُ فِي ظِلِهِ يَوْمَ لَا ظِلَّ إِلَّا ظِلُّهُ
"কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ সাত শ্রেণির ব্যক্তিকে তাঁর আরশের ছায়া দ্বারা আচ্ছাদিত করবেন, যেদিন ঐ ছায়া ব্যতীত আর কোনো ছায়া থাকবে না।"
উপর্যুক্ত হাদীসে সাত শ্রেণির মানুষের পরিচয় পেশ করা হয়েছে। অর্থাৎ এখানে ৭টি বিশেষ সৎকর্মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। দুনিয়ার জীবনে যারা দুনিয়াদারীতে ডুবে আল্লাহকে ভুলে না গিয়ে, একমাত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাঁকে ভয় করে জীবনের প্রতিটি কার্যক্রম পরিচালনা করেছে, এমন বিশেষ সাত শ্রেণির লোককে মহান আল্লাহ বিচারের দিন হাশরের ময়দানে কঠিন সময় তাঁর বিশেষ ছায়ার নিচে আশ্রয় দান করবেন।
হাদীসটির ব্যাখ্যার শুরুতে আখিরাত দিবসের ভয়াবহতা ও বিভীষিকার বর্ণনা তুলে ধরা জরুরি মনে করছি। যাতে করে সে দিনের পেরেশানী ও মহাবিপদ থেকে বাঁচার অদম্য আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
কেমন হবে হাশরের ময়দানের অবস্থা - কঠিন হাশরের দিনে যা হবে
ইহকালই মানব জীবনের শেষ নয়। মৃত্যুর পরও মানুষের জন্য রয়েছে এক অনন্ত জীবন। মৃত্যুর পর মুহূর্ত থেকে এ অনন্ত জীবন শুরু হয়। এ জীবনের শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই, এটির নাম আখিরাত। সেখানে মানুষকে তার পার্থিব জীবনের সকল কর্মকাণ্ডের হিসাব মহান স্রষ্টার কাছে দিতে হবে।
আখিরাতের চারটি স্তর রয়েছে। এর মধ্যে হাশর দিবস তৃতীয় স্তর। সেদিন মানুষের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে। তাদের কর্মের প্রতিদান দেয়তার জন্য সেদিন সবাইকে এক ময়দানে সমবেত করা হবে।
পবিত্র কুরআন ও হাদীসে বলা হয়েছে, হাশরের দিবস হবে ভয়াবহ গরমের দিন। গরমের তাপে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ বিভিন্ন দিকে ছোটাছুটি করতে থাকবে। তিনটি কারণে সেদিন প্রচণ্ড তাপ প্রবাহিত হবে। যথা-
১. হাশর দিবসে সূর্য মাথার সামান্য উপরে নেমে আসবে,
২. প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে তাপ মাত্রা অনেক বেড়ে যাবে।
৩. জাহান্নামকে মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসা হবে।
ক. হাশর দিবসে সূর্য মাথার সামান্য উপরে নেমে আসবে:
ইবনে আসওয়াদ (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন,
تُدْنَى الشَّمْسُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنَ الْخَلْقِ، حَتَّى تَكُوْنَ مِنْهُمْ كَمِقْدَارِ مِيْلٍ
"শেষ বিচার দিবসে সূর্য মানুষের নিকট থেকে এক মাইল দূরে অবস্থান করবে।" অনুরূপভাবে আবূ হুরায়রা থেকে বর্ণিত, রাসূল (স.) বলেছেন,
يَعْرَقُ النَّاسُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يَذْهَبَ عَرَفُهُمْ فِي الْأَرْضِ سَبْعِينَ ذِرَاعًا. وَيُلْحِمُهُمْ حَتَّى يَبْلُغَ أَذَاتَهُمْ
"কিয়ামতের দিনে মানুষের ঘাম হবে; এমনকি তাদের ঘাম জমিনে ৭০ গজ ছাড়িয়ে যাবে এবং তাদের মুখ পর্যন্ত ঘামে ডুবে যাবে, যা কান পর্যন্ত পৌঁছাবে।"
খ. হাশরের মাঠের ভয়াবহতা, মৃত্যু ও কবরের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি হবে:
আনাস ইবনে মালেক (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, "যখন থেকে আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তখন থেকে তার ওপর মৃত্যুর চেয়ে যন্ত্রণাদায়ক সময় আর কখনো আসেনি, আর মৃত্যুর পরের স্তরগুলো মৃত্যুর চেয়েও বেদনাদায়ক। নিশ্চয়ই মানুষ হাশরের দিনের কষ্টে অতিষ্ঠ হয়ে যাবে। দেহ থেকে ঘাম ঝড়তে থাকবে। ঘাম এত অধিক পরিমাণে প্রবাহিত হবে যে, যদি কেউ ঘামের মাঝে নৌকা চালাতে চায় তাহলে তাও সম্ভব হবে।"
গ. প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের চিন্তায় মগ্ন থাকবে:
এক ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করবে। নীরব ও নিথর হয়ে সকলেই দাঁড়িয়ে থাকবে, কেউ কাউকে কোনো প্রশ্ন করবে না, কুশল বিনিময় করবে না। সেসময় সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে পড়বে, পৃথিবীর পরিচিত সকল মূল্যবোধ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সেদিন আত্মীয়তার বন্ধন থাকবে না। এমনকি সেই দিন রক্তের বন্ধনও থাকবে না। সেদিনের অবস্থা এত ভয়াবহ থাকবে যে, মানুষ উলঙ্গ থাকবে কিন্তু কেউ কারো দিকে তাকানোর সুযোগ পাবে না।
আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, "শেষ বিচার দিবসে লোকদেরকে উলঙ্গ, খালি পা ও খতনাহীন অবস্থায় উঠানো হবে," আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! নারী ও পুরুষরা একে অপরের দিকে তাকাবে না? তিনি বললেন, "হে আয়েশা! সে দিনটি এত ভয়াবহ হবে যে, একে অপরের দিকে তাকানোর মতো হুঁশ থাকবে না।"
ঘ. হাশরের দিনটি দুনিয়ার পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান:
আল্লাহ্ বলেন,
"ফিরিশতারা ও রূহ এমন এক দিনে ঊর্ধ্বগামী হবে, যার পরিমাণ ৫০ হাজার বছর।"
হাশরের ময়দানে আরশের ছায়া প্রাপ্ত সাত শ্রেণির ব্যক্তি
এখন আমারা জানবো কোন সাত শ্রেণির লোক আরশের ছায়াতলে স্থান পাবে। যে সাত শ্রেণীর মানুষ আরশের ছায়া পাবে তাদের ব্যপারে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ
এক. ন্যায়পরায়ণ বাদশা বা শাসকঃ
হাশরের দিন মহান আল্লাহ তায়ালার আরশের নিচে যারা ছায়া পাবেন তাদের মধ্যে ১ শ্রেণি হলো 'আল-ইমামুল আদিল' অর্থাৎ ন্যায়বান শাসক। অবশ্য এটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবোধক কথা।
এর দ্বারা শুধু মাত্র রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিকেই বুঝায় না; বরং পরিবার-সমাজ, অফিস-আদালত, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিতে যারাই নেতৃত্বে বা প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকেন, তারা সবাই এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন।
কেননা তাদের অধীনে যারা কাজ করেন তাদের প্রতি তারা কতটা ইনসাফ করেন এর ভিত্তিতেই তাদের বিচার হবে।
এ প্রসঙ্গে ইবন উমার (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন,
"তোমরা প্রত্যেকেই ১ জন রাখাল তথা দায়িত্বশীল এবং তোমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। যিনি ইমাম বা শাসক তিনি দায়িত্বশীল, তিনি তার দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবেন। ১ জন পুরুষ তার পরিবারবর্গের উপর দায়িত্বশীল এবং তিনি জিজ্ঞাসিত হবেন। একজন নারীও তেমনি তার স্বামীর ঘরে দায়িত্বশীলা এবং তিনিও তার দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবেন। দাসও তার মনিবের সম্পদের ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং সেও জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব খবরদার! তোমরা সকলেই নিজ নিজ জায়গায় দায়িত্বশীল এবং তোমরা সকলেই নিজের অধীনস্ত লোকদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।
মানব সমাজে সকলকেই যেহেতু কোনো না কোনো পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করতে হয়। আর এ দায়িত্বের ব্যাপারে সকলকেই জিজ্ঞাসিত হতে হবে।
মনে রাখতে হবে যার দায়িত্ব যত বেশি তার জবাবদিহিতাও তত বেশি। তাই মানব সমাজের কেউই দায়িত্বমুক্ত নয়। ন্যায়পরায়ণতা বলতে প্রত্যেককে তার প্রাপ্য অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর বিধান অনুসরণ করাকে বুঝানো হয়েছে।
ন্যায়ের বিপরীত হলো অত্যাচার বা অনাচার। মহান আল্লাহ এ বিষয়ে বলেন,
وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ
"যখন লোকদের মধ্যে বিচার করবে, তখন ইনসাফের সাথে করবে।"
এ আয়াতে 'আদলের' সাথে বিচার ফয়সালা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 'আদল' অর্থ ইনসাফ করা, ন্যায়বিচার করা, ভারসাম্য রক্ষা করা, যার যা প্রাপ্য তাকে তা প্রদান করা। অর্থাৎ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবন তথা জীবনের সকল ক্ষেত্রে ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক বিচার ফয়সালা করাকে 'আদল' বলে।
'আদল' তথা ন্যায়বিচার করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয। আল- কুরআনের বহু স্থানে ইনসাফের সাথে বিচার ফয়সালা করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। মানুষের সার্বিক জীবনব্যবস্থাকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজন কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুনের। এ ক্ষেত্রে বিশেষত বিচারব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সুবিচার যে কোনো সমাজে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। ইসলামী আইন ও বিচারব্যবস্থা আল্লাহ প্রদত্ত, তাই এটা সন্দেহাতীতভাবে নিরপেক্ষ ও সুবিচারপূর্ণ।
একমাত্র ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থাই দিতে পারে মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তিনিই ঠিক করে দিতে পারেন মানুষের জীবনের সার্বিক মূলনীতি। কুরআন ও সুন্নাহ বর্ণিত সুসামঞ্জস্য বিচার ব্যবস্থাই দিতে পারে সঠিক বিচারের নিশ্চয়তা।
মহান আল্লাহ ইনসাফপূর্ণ বিচার করার জন্য নির্দেশ দিয়ে বলেন,
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَ الْإِحْسَانِ وَ ايْتَايْ ذِي الْقُرْنِى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ
"আল্লাহ সুবিচার, বদান্যতা ও নিকটাত্মীয়ের হক আদায় করার আদেশ দিচ্ছেন এবং বেহায়াপনা, নিষিদ্ধ কাজ ও যুলুম করা থেকে নিষেধ করছেন। তিনি তোমাদেরকে নসীহত করছেন, যাতে তোমরা উপদেশ নিতে পারো।"
ন্যায় বিচারকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন। তাই মহান আল্লাহ বলেন,
إنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ
"নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়বিচারকারীকে পছন্দ করেন।"
কুরআন অনুযায়ী যারা বিচার করে না, তাদেরকে মহান আল্লাহ যালিম, ফাসিক ও কাফির হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বলেন, যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিচার- ফয়সালা করে না কুরআন মাজীদে তাদেরকে কাফির, যালিম ও ফাসিক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তা যদি নিজ পিতা-মাতা বা নিকটজনের বিরুদ্ধেও যায় তবুও ন্যায়ের উপর সুদৃঢ় থাকার উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়েছে। অনুরূপভাবে অমুসলিম ও অবিশ্বাসীদের ক্ষেত্রেও মহান আল্লাহ সুবিচারের নির্দেশ দিয়েছেন।
ইসলামী আইনে বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগের প্রভাব হতে মুক্ত ও পরিপূর্ণ স্বাধীন। একজন সাধারণ নাগরিক রাষ্ট্রের যে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করতে পারে। এমনকি স্বয়ং খলিফার বিরুদ্ধেও এই মামলা পেশ হতে পারে এবং ফরিয়াদীর স্বত্ব প্রমাণিত হলে আল্লাহর আইন খলিফার প্রতি প্রযোজ্য হবে। আদালতের সীমার মধ্যে স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধান পদমর্যাদারও কোনো গুরুত্ব থাকবে না।
সিফফীনের যুদ্ধের প্রাককালে আমীরুল মু'মিনীন হযরত আলীর (রা.) একটি বর্ম হারিয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধ করে ফেরার পথে একজন ইহুদীর কাছে তা দেখে বললেন, "আমি এই বৰ্মটা কাউকে দানও করিনি, বিক্রিও করিনি। তাহলে এটা তোমার কাছে কিভাবে গেল?" ইহুদী বলল, "এটা তো আমার বর্ম।" খলিফাতুল মুসলিমীনের বর্ম চুরি করা সোজা কথা নয়। তিনি ইচ্ছা করলেই চোরকে গ্রেফতার করে শাস্তি দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সাধারণ নাগরিকের ন্যায় আদালতে হাজির হয়ে মোকদ্দমা দায়ের করেছিলেন।
কাযীর আসনে বসেছিলেন বিচারপতি শুরাইহ (রা.)। তিনি খলিফার দাবি ও ইহুদীর জবাব শুনে হযরত আলী (রা.) কে সাক্ষী হাজির করার আদেশ দিলেন। খলিফা আলী (রা.) বললেন, আমার ছেলে হাসান ও ক্রীতদাস কিম্বার সাক্ষী আছে। কাযী শুরাইহ (রা.) বললেন, বাবার পক্ষে ছেলের ও মনিবের পক্ষে ক্রীতদাসের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। বিধায় মামলাটি খারিজ করে দিলাম।
সহসা ইহুদী চিৎকার করে বলে উঠল, না কাযী সাহেব, না। এ বর্ম হযরত আলীর। যে ধর্মে ক্ষমতাসীন খলিফাকে একজন মামুলী কাযী সাধারণ মানুষের মত জেরা করে ও তার বিরুদ্ধে রায় দেয়, সে ধর্ম সত্য না হয়ে পারে না। এই বলেই ইহুদী ইসলাম গ্রহণ করল।
ইসলামী বিচার নীতি অনুসারে খলিফাতুল মুসলিমীন নিরপেক্ষ সাক্ষী পেশ করতে পারেননি। স্বয়ং খলিফা বা রাষ্ট্রপ্রধানের আদালতে হাযির হয়ে মামলা দায়ের এবং কাযীর নির্ভীক চিত্তে খলিফার মামলা খারিজ করার মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং আইনের প্রাধান্যের যে নজির স্থাপিত হলো তা অনন্য।
ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে বড়-ছোট, গরিব-ধনী, শাসক-প্রজা, উঁচু-নিচু, আপন-পর এবং মুসলিম-অমুসলিমের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। সকলের প্রতিই তাঁর নিরপেক্ষ বিচারদও সমানভাবে প্রযোজ্য। মুসলিম ব্যক্তির প্রতি পক্ষপাতিত্ব মুসলিম বিচারকের পক্ষে অমার্জনীয় অপরাধ।
রাসূল (স.) নিজেকে পর্যন্ত বিচার ও প্রতিশোধের জন্য পেশ করতেন। কুরাইশ বংশের বনু মাখযুম শাখার ফাতিমা নামী এক মহিলা চুরি করে ধরা পড়ল। তাকে রাসূলের (স.) দরবারে হাজির করা হলো শান্তি দেয়ার জন্য। কুরাইশদের জন্য ব্যাপারটা বড়ই বিব্রতকর হয়ে দেখা দিল। তাই তারা ভাবল কাউকে দিয়ে শাস্তি মওকুফ করার সুপারিশ করা দরকার।
স্থির হলো উসামা ইবন যায়িদ রাসূলের (স.) অত্যন্ত প্রিয়পাত্র, তাই কুরাইশেরা তাকেই রাসূলের দরবারে সুপারিশের জন্য পাঠালেন। তিনি রাসূলের (স.) সাথে আলোচনা করলেন, সব কথা শুনে রাসূল (স.) ভীষণ ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি উসামাকে বললেন, স্বয়ং আল্লাহর নির্ধারিত শাস্তি হুদুদুল্লাহর ব্যাপারে সুপারিশ করতে এসেছ, এতদূর ধৃষ্টতা তোমার?
এরপর সবাইকে একত্রিত করে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলো ধ্বংসের প্রধান কারণ ছিল এই যে, তাদের দৃষ্টিতে যারা অভিজাত ছিল, তাদের কেউ অপরাধ করলে তাকে শাস্তি দিত না। আর কোনো দুর্বল ব্যক্তি অপরাধ করলে তাকে শাস্তি দিত। আল্লাহর শপথ! চুরির অপরাধে ধৃত এই ফাতিমা যদি মুহাম্মদের (স.) মেয়ে ফাতিমাও হত, তবে আমি তার হাতও না কেটে ছাড়তাম না।
যে ব্যক্তি বিচার কাজে নিযুক্ত হয় অতঃপর তিনি ইনসাফপূর্ণ বিচার করেন তার জন্য রয়েছে জান্নাত। আর যিনি যুলুম, অবিচার করেন তার জন্য রয়েছে জাহান্নাম।
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, বিচারক তিন ধরনের। দুই ধরনের বিচারক জাহান্নামী এক ধরনের বিচারক জান্নাতী। যে সত্য জেনেও অন্যায় বিচার কার্য করে, সে জাহান্নামী। যার বিচার কার্যের জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও বিচার কার্য করল সে জাহান্নামী। আর যে সত্যকে জানল এবং সে অনুযায়ী বিচারের রায় দিল সে জান্নাতী।
মুয়ায ইবন জাবাল (রা.)-কে ইয়ামানের প্রতিনিধি করে পাঠানোর সময় রাসূলুল্লাহ (স.) তাকে সর্বশেষ নির্দেশ দিয়ে ছিলেন, হে মুয়ায! মজলুমের বদ দু'আকে ভয় করবে, কারণ মজলুম যখন আল্লাহর নিকট দু'আ করে তখন তার এবং আল্লাহর মাঝে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে না।
দুই. যে যুবক তার যৌবনকাল আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়েছে
রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন,
وَشَابٌ نَشَأَ بِعِبَادَةِ اللهِ
"যে যুবক মহান আল্লাহর ইবাদতের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠে।" এখানে যুবককে বিশেষিত করা হয়েছে এ কারণে যে, যৌবনকালে বেশি তাড়িত হয়ে থাকে মানুষ প্রবৃত্তি দ্বারা। তাই আল্লাহভীতিকে প্রাধান্য দিয়ে প্রবৃত্তিকে দমন করে যে যুবক আল্লাহ'র ইবাদতে আত্মনিয়োগ করে তার জন্য এ মহান পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।
মূলত ১৫ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত সময়কে যৌবনকাল বলা হয়। জাতিসঙ্ঘ ১৯৯৮ সালের ১২ আগস্টকে আন্তর্জাতিক যুব দিবস ঘোষণা করেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ এবং বাংলাদেশের তিন ভাগের এক ভাগ যুবক।
যৌবনকাল হলো মানুষের জীবনকালের মধ্যবর্তী সময়। শিশুকালে মানুষ থাকে দুর্বল, আর বৃদ্ধকালে হয় পরনির্ভরশীল। মাঝের সময়টুকুই শক্তি ও বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে দ্বিপ্রহরের সূর্যের মতো প্রখর।
যৌবনের উদ্যমতা ও শক্তিমত্তাকে যদি সঠিক পন্থায়, সঠিক কাজে ব্যয় করা যায়, তাহলে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ সুষ্ঠ ও সুন্দরভাবে গড়ে উঠবে। কারণ এই যুবকরাই জাতির মেরুদণ্ড। এরা সুসংহত হলে গোটা জাতি সুসংহত হয়। এরা পথ হারালে গোটা জাতিই পথ হারায়।
যুবক বয়সের অধিকাংশ ব্যক্তিই দুনিয়ার চাকচিক্য ও সৌন্দর্য নিয়েই ব্যস্ত থাকে। তারা পরকালের কথা ভুলে যায়। অথচ মহান আল্লাহর কাছে যুবক বয়সের ইবাদতের মর্যাদা ও গুরুত্ব অনেক বেশি। তখন বেশির ভাগ মানুষই সুস্থ থাকে এবং সব ইবাদত যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম হয়।
তাই যুবকদের ইবাদত আল্লাহ বেশি পছন্দ করেন। এ বয়সের ইবাদতকারীরা হাশর দিবসে আল্লাহর আরশের ছায়াপ্রাপ্ত হবেন। তাই রাসূল (স.) বলেছেন, "যে তার যৌবন আল্লাহর আনুগত্য তথা ইবাদতে কাটিয়ে দিয়েছে সে হাশরে আল্লাহর আরশের ছায়াপ্রাপ্ত হবে।"
মহান আল্লাহ যুবকদের মধ্য থেকেই নবুওয়াতের দায়িত্ব দিয়েছেন। ইবন আব্বাস (রা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ সমস্ত নবীদের যৌবনকালে নবুয়ত দান করেছেন।
বার্ধক্য আসার পূর্বেই যৌবনকে গুরুত্ব দেয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করে রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন,
إِغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ شَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ وَصِخْتَكَ قَبْلَ سُقْمِكَ وَعِنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ وَقِرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ (تِرْمِزِيْ)
তোমরা পাঁচটি বিষয়কে অপর পাঁচটি বিয়ষের পূর্বে গুরুত্ব প্রদান করো-
ক. যৌবনকে বার্ধক্য আসার আগে গুরুত্ব দাও।
খ. সুস্থতাকে রোগাক্রান্ত হওয়ার আগে গুরুত্ব দাও।
গ. সচ্ছলতাকে দরিদ্র হওয়ার আগে গুরুত্ব দাও।
ঘ. অবসরকে ব্যস্ত হওয়ার আগে গুরুত্ব দাও।
ঙ. হায়াতকে মৃত্যু আসার আগে গুরুত্ব দাও।
রাসূলুল্লাহ (স.)-এর আন্দোলনে যুবকদের অংশগ্রহণে আধিক্যতা পরিলক্ষিত হয়। যেকোনো আন্দোলনে যুবকেরাই আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি বদলে দেয়। যুবকেরাই সমাজ-দেশ-কালের চালিকাশক্তি। ইসলাম গ্রহণের দিক থেকেও যুবকরা ছিল অগ্রণী।
রাসূলুল্লাহ (স.)-এর আন্দোলনে বৃদ্ধ লোকের চেয়ে যুবকদের সংখ্যাই বেশি ছিল। বয়োবৃদ্ধদের অনেকেই দ্বীনি আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন। তরুণ-যুবকদের রক্তই হলো ইসলামী আন্দোলনের ভিত্তি। মহান আল্লাহর রহমতে সেই যুবকদের ত্যাগের বিনিময়েই এই পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছেছে।
আলী ইবন আবূ তালিব, জাফর, তালহা, যুবাইর, সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস, আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ, মুসআব ইবন উমাইর (রা.) সকলের বয়স ইসলাম গ্রহণের সময় ২০ বছরের নিচে ছিল।
আব্দুর রহমান ইবনে আওফ, বেলাল ও সোয়াইব (রা.)-এর বয়স ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ছিল। আবূ ওবায়দা ইবন জাররাহ, যায়িদ ইবন হারিসা, উসমান ও উমর ফারুক (রা.)-এর বয়স ৩০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে ছিল।
এভাবে আরো অনেকে যৌবনকালে ইসলাম গ্রহণ করেন। এ সব তরুণ সাহাবারা আমাদের প্রেরণার উৎস। আসহাবে কাহাফের সাত ব্যক্তিও ছিল যুবক। যাদেরকে শত্রুর হাত থেকে আল্লাহ রক্ষা করেছিলেন।
আমাদের প্রিয় নবী (স.) যুবকদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাদের লক্ষ্য করে বলেছেন, "আমি তোমাদেরকে তরুণ-যুবকদের কল্যাণকামী হওয়ার জন্য নসিহত করছি, আদেশ দিচ্ছি। তাদের হৃদয় অত্যন্ত কোমল। মহান আল্লাহ আমাকে উদারতা দান করেছেন এবং মানুষকে আল্লাহর দিকে ফিরে নেয়ার জন্যই পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আমাকে যুব সম্প্রদায় সহযোগিতা করেছে। আর দ্বীনি আন্দোলনে বয়োবৃদ্ধ শ্রেণি বাধা সৃষ্টি করেছে।"
ইসলামের চরম প্রতিকূলতা মোকাবেলায় যুবকদেরই অগ্রগামী হতে দেখা যায়। ইসলামের প্রতিটি সঙ্কটে বীর তরুণ-যুবকেরাই এগিয়ে এসেছেন। বুক ফুলিয়ে গর্দান উচিয়ে অভিযানে বের হয়েছেন। জীবনের মায়া তুচ্ছ করে মহাসমরে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
ইসলামের যুদ্ধগুলোতে বেশির ভাগ সেনাপতিই ছিলেন যুবক। হযরত আলী, উসামা বিন যায়েদ, খালিদ ইবন ওয়ালিদ, মুসা ইবন নুসাইর, ওকবা ইবন নাফে (রা.), তারেক ইবন জিয়াদ, মুহাম্মদ ইবন কাসিম, সালাহ উদ্দিন আইয়ুবি, বখতিয়ার খিলজী প্রমুখ মরুর ধূসর দিগন্ত পাড়ি দিয়ে বিজয় নিশান ছিনিয়ে এনেছেন। শৌর্যবীর্যে অবাক করে দিয়েছেন সমকালীন পৃথিবীকে। ফলে নতুন এক সভ্যতার জন্ম হয়েছিল।
যৌবনকাল মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এটি আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত। এ সময়ের ইবাদতের মর্যাদাও বেশি। অতএব, যৌবনের উচ্ছলতায় বিবেক বুদ্ধি হারিয়ে ভুল পথে না চলে কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক জীবন পরিচালনা করি। আর অভিভাবক হিসেবে আমরা যারা আছি, এ ক্ষেত্রে তাদেরকে সার্বিক সহযোগিতা করি।
তিন. এমন মুসলিম যার অন্তর মসজিদের সাথে ঝুলন্ত থাকে
রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন,
وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِي الْمَسَاجِدِ
"আর সেই ব্যক্তি যার হৃদয় মসজিদে ঝুলে থাকে।"
মসজিদের বাইরে অবস্থান করলেও মসজিদের সাথে মন লেগে থাকে এবং অপেক্ষায় থাকে আবার কখন মসজিদে প্রবেশ করবে। এমনিভাবে যে কোনো কাজেই থাকুক না কেন আযানের সময়ের অপেক্ষায় থাকবে এবং যথাসময়ে মসজিদে প্রবেশ করবে।
কেউ কেউ এর দ্বারা মসজিদের প্রতি মহব্বত বা ভালোবাসাকে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ মসজিদ থেকে বের হয়ে পুনরায় মসজিদে প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত এর সাথে ভালোবাসা পোষণ করা। কেননা পানির মধ্যে মাছ যেমন প্রশান্তি পায় মুমিন তেমনি মসজিদে প্রশান্তি পায়। খাঁচার মধ্যে পাখি যেমন ছটফট করে মুনাফিক তেমনি মসজিদের মধ্যে ছটফট করে।
আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমানের সাক্ষ্য দানের পরই সালাতের স্থান। এ সালাতকে জামা'আতের সাথে মসজিদে আদায় করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। সালাত জামাআতের সাথে আদায় করা ওয়াজিব।
মহান আল্লাহ আল-বাকারাহর ৪৩ তম আয়াতে রুকুকারীদের সাথে অর্থাৎ জামা'আতের সাথে সালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়ে বলেন,
"তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু কর।" অর্থাৎ সালাত আদায়কারীর সাথে জামা'আতে সালাত আদায় কর।
ইবন উম্মে মাকতুম (রা.) রাসূল (স.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, 'হে আল্লাহর রাসুল! আমি একজন অন্ধ মানুষ, আমার বাড়িও মসজিদ থেকে অনেক দূরে এবং আমার একজন পথচালক আছে সে আমার পছন্দনীয় নয়। আমার জন্য ঘরে সালাত পড়ার অনুমতি আছে কি ?' রাসূল (স.) বললেন
"তুমি কি আজান শুন?" বললেন হ্যাঁ। তারপর রাসূল (স.) বললেন, "তাহলে আমি তোমার জন্য জামা'আতে অনুপস্থিত থাকার কোনো অনুমতি দিচ্ছি না।"
শরী'আত সম্মত উযর ছাড়া জামা'আত হতে বিরত থাকার সুযোগ নেই। ইবন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (স.) বলেন,
مَنْ سَمِعَ النِّدَاءَ فَلَمْ يَأْتِهِ ، فَلَا صَلَاةَ لَهُ ، إِلَّا مِنْ عُدْرٍ
"যে ব্যক্তি আজান শ্রবণ করার পর উ'যর ছাড়া সালাতে উপস্থিত হয় না তার সালাতই হয় না।"
রাসূল (স.) জামা'আত ত্যাগকারীর বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। জামা'আতে সালাত হতে বিরত থাকা মুনাফিকের নিদর্শন। রাসূল (স.) বলেন, 'মুনাফিকের জন্য ফজর আর এশার সালাত যত কষ্টকর অন্য আর কোনো সালাত অনুরূপ কষ্টকর নয়। তারা যদি এ দু'টি সালাতের সওয়াব সম্পর্কে জানত, তাহলে নিতম্বে ভর করে হলেও এ দুই সালাতে উপস্থিত হত।"
মসজিদে সালাতের জন্য গমন করাকে ইহরাম বেঁধে হজ্জের উদ্দেশ্যে গমন সমতুল্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
সালাতের জন্য মসজিদে গমনকারীর জন্য নূরের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে।
মসজিদে জামা'আতে সালাত আদায়ের জন্য গমন করলে গুনাহ মাফ করা হয়। হযরত উসমান ইবন আফফান (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (স.) বলেন,
"যে ব্যক্তি পরিপূর্ণভাবে সালাতের ওজু করে, তারপর ফরজ সালাতের উদ্দেশ্যে পথ চলে এবং মসজিদে জামাআতে সালাত আদায় করে, আল্লাহ তা'আলা তার যাবতীয় গুনাহ ক্ষমা করে দেন।"
মসজিদে জামা'আতে সালাত আদায় করলে জাহান্নামের আগুন হতে নিষ্কৃতি ও নিফাক হতে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।
صَلَاةُ الْجَمَاعَةِ أفْضَلُ مِنْ صَلَاةِ الْفَذِ بِسَبْعٍ وَعِشْرِينَ دَرَجَةً
"জামা'আতের সাথে সালাত একাকী সালাতের চেয়ে সাতাশ গুণ বেশি মর্যাদাপূর্ণ।"
চার. আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় পরস্পরকে ভালোবাসা
রাসূল (স.) বলেছেন,
وَرَجُلَانِ تَحَابًا في اللهِ اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ
আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসা পোষণকারীর মর্যাদা প্রসঙ্গে উমর ইবন খাত্তাব (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, "নিশ্চয়ই আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে যারা নবীও নন এবং শহীদও নন। অথচ আম্বিয়া ও শহীদগণ কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট তাদের মর্যাদা দেখে ঈর্ষা বোধ করবেন।" সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি কারা? জবাবে তিনি বললেন,
"এরা সেই সব ব্যক্তি যারা পরস্পরকে কেবল আল্লাহর দ্বীনের ভিত্তিতেই ভালোবাসতো। তাদের মধ্যে আত্মীয়তার কোনো বন্ধন কিংবা ধন-সম্পদ আদান প্রদানের কোনো সম্পর্ক ছিলো না।" আল্লাহর কসম! এদের চেহারা হবে জ্যোতির্ময়। নিঃসন্দেহে তাঁরা নূর দ্বারাই পরিবেষ্টিত থাকবে। মানুষ যখন থাকবে ভীত বিহ্বল তখন এরা থাকবে শংকাহীন। মানুষ যখন থাকবে চিন্তায় নিমগ্ন তখন এরা থাকবে সম্পূর্ণ চিন্তামুক্ত।
মদীনার আনসারগণ হিজরতকারী মুসলমানদের সাথে ভ্রাতৃত্বের যে দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে কেউ কোনো দিন তা দেখাতে পারেনি এবং পারবেও না। সাহাবা-তাবেঈন, সালফে সালেহীনদের মাঝে এই ভালোবাসার বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। মুতার যুদ্ধের সেই তিন যোদ্ধা- যারা পিপাসার্ত অবস্থায় হাতের নাগালে পানি পেয়েও অন্য ভাইয়ের জন্য উৎসর্গ করেছেন এবং শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেছেন- এটাই ঈমানী ভ্রাতৃত্বের মূর্ত প্রতীক।
ঈমানের ভিত্তিতে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহর ঘোষণা হলো, 'মু'মিনরা পরস্পর ভাই ভাই।
কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন স্থানে নানা আঙ্গিকে বর্ণিত হয়েছে এ বন্ধনের গুরুত্বের কথা। সূরাহ আত-তাওবার ৭১ তম আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,
وَ الْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنْتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ
"মু'মিন নর ও নারী সকলেই একে অন্যের বন্ধু।"
সাহল ইবন সা'দ (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন, "একজন মু'মিনের সাথে অপর একজন মু'মিনের সম্পর্ক তদ্রুপ, যেমন- দেহের সাথে মাথার সম্পর্ক। একজন ঈমানদার অপর ঈমানদার ভাইয়ের জন্য কষ্ট অনুভব করবে, যেমন- মাথা দেহের প্রতিটি অংশের ব্যাথা অনুভব করে।"
ভ্রাতৃত্ব একটি মজবুত প্রাসাদের সাথে তুলনা করে হাদীসে বলা হয়েছে যে, আবূ মূসা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন,
إِنَّ الْمُؤْمِنَ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا
"মু'মিনগণ যেন একটি প্রাচীর, যার একাশং অপরাংশের শক্তিযোগায়।"
মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ সহোদর ভাইয়ের চেয়ে কম নয়; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়েও সুদৃঢ়। কেননা দ্বীন ও ঈমানের জন্য রক্ত সম্পর্কীয় ভ্রাতৃত্ব ছিন্ন করা যায়, কিন্তু পবিত্র ইসলামের ভিত্তিতে যে ভ্রাতৃত্ব গড়ে ওঠে তা ছিন্ন করা চলে না। এজন্যই এক মুসলমান অপর মুসলমান ভাইয়ের সাথে তিন দিন পর্যন্ত কথাবার্তা না বলা বা সম্পর্ক ছিন্ন করে থাকা বৈধ নয়।
এ মর্মে মহানবী (স.) বলেন, "কোনো মুসলিমের পক্ষে তার ভাইকে তিন দিনের অধিক সময়ের জন্য সম্পর্কহীন করে রাখা বৈধ নয়।"
বিশ্বমুসলিম ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে মানুষের পারস্পরিক হিংসা বিদ্বেষ, হানাহানি ও দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত শত্রুতা বিদূরিত হয়ে সহোদর তুল্য ভ্রাতৃতুল্য সমন্ধ গড়ে ওঠার পথ সুগম হয়। তাই রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন, "এক মুসলমানের জীবন সম্পদ এবং মান সম্মান হরণ করা অপর মুসলমানের উপর হারাম।"
পাঁচ. অশ্লীলতা থেকে চরিত্রের হিফাযত
রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন,
وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ، فَقَالَ: إِنِّي أَخَافُ الله
"যাকে অভিজাত বংশীয় কোনো সুন্দরী রমণী কুকর্মের জন্য ডাকে। আর সে উত্তরে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি।"
আল্লাহর নবী ইউসুফ (আ.) মিশরের আযীয পত্নী জুলায়খার আহ্বানে সাড়া না দিয়ে জেলখানাকে উত্তম বাসস্থান হিসেবে গ্রহণ করেছেন, যা পবিত্র কুরআনের সূরাহ ইউসুফে উল্লেখ রয়েছে। সূরাতুল মু'মিনুনসহ আল-কুরআনের চারটি আয়াতে যৌনাঙ্গ হিফাযত করার কথা বলা হয়েছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে যিনা ব্যভিচার কবীরাহ গুণাহসমূহের মধ্যে জঘন্যতম। আল-কুরআনের পাঁচটি আয়াতে 'যিনা' শব্দটি ৮ বার উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ এ অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেন,
"হে মু'মিনগণ! তোমরা অবৈধ যৌন-সংযোগের কাছেও যেওনা। এটা অশ্লীল। ও নিকৃষ্ট আচরণ।"
অত্র আয়াতে বলা হয়েছে- যিনার কাছেও যেয়ো না। এর অর্থ হলো যিনার প্রাক্কালীন কার্যাবলী এবং যিনা সহজ ও সম্ভব করে যেসব কার্যাবলী, তা তোমরা নিজেও করো না এবং সমাজেও হতে দিও না।
রাসূল (স.)-এর হাদীসেও যিনা-ব্যভিচারের কঠিন ভয়াবহতা সম্পর্কে অনেক সতর্ক বাণী বর্ণিত হয়েছে। রাসূল (স.) বলেন, "যতদিন আমার উম্মাতের মধ্যে যিনা-ব্যভিচার ছড়িয়ে না পড়বে, ততদিন তারা কল্যাণেই থাকবে। আর তাদের মধ্যে যিনা ব্যভিচার প্রসার লাভ করলে আল্লাহ তাদের মধ্যে শাস্তি নাযিল করবেন।"
রাসূল (স.) আরো বলেন, "হে লোকসকল! তোমরা যিনাকে ভয় কর, কেননা যিনার মধ্যে ছয়টি মন্দ পরিণাম রয়েছে। তিনটি দুনিয়াতে এবং তিনটি আখিরাতে। দুনিয়াতে তিনটি হলো-
১. সৌন্দর্যহানী
২. দারিদ্র
৩. অকালমৃত্যু।
আর আখিরাতের তিনটি হলো-
১. আল্লাহর অসন্তুষ্টি
২. হিসাবে মন্দ পরিণাম
৩. জানান্নামের শাস্তি।
অতএব ইসলামী আইনে যিনাকে কবীরা গুনাহ ও "হদ্দ" তথা বিধিবদ্ধ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এ অপরাধ সৎচরিত্রের পরিপন্থী।
ছয়. গোপনে দান করা - গোপনে দান করার ফজিলত
রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন,
"যে ব্যক্তি গোপনে দান করে, এমনকি তার ডান হাত দ্বারা কী দান করল, বাম হাত তা টের পায় না।"
এখানে দুটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। দানকারীর জন্য পুরস্কার এবং দানের ক্ষেত্রে রিয়া বা লৌকিকতা থেকে রক্ষা পাবার গুরুত্ব কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, গোপনে ও প্রকাশ্যে সর্বাবস্থায়ই দান করা যায়। নিয়্যাতের বিশুদ্ধতা থাকলে সব ইবাদাতের সওয়াব আল্লাহ প্রদান করবেন, তবুও এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ (স.) গোপনে দান করতে উৎসাহিত করেছেন। গোপনে দান করার ফজিলত হল এর মাধ্যমে 'রিয়া' থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
গোপনে ও প্রকাশ্যে উভয় পন্থায় দান করা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,
"যারা আল্লাহ্র রাস্তায় স্বীয় ধন সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ একটি বীজের মত, যা থেকে সাতটি শীর্ষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে একশ করে দানা থাকে। আল্লাহ্ অতি দানশীল, সর্বজ্ঞ।"
রাসূল (স.) বলেন, "দানশীলতা জান্নাতের একটি গাছ, যার ডাল-পালা পৃথিবী পর্যন্ত ঝুলনো। যে ব্যক্তি তার একটি ডাল ধরবে, সে ডাল তাকে জান্নাতে টেনে নেবে। আর কার্পণ্য জাহান্নামের একটি গাছ, যার ডাল-পালা পৃথিবী পর্যন্ত ঝুলান। যে কেউ তার একটি ডাল ধরবে, সে ডাল তাকে জাহান্নামে টেনে নেবে।"
আল্লাহর পথে দানের সুফল লাভ করতে হলে অবশ্যই তা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হতে হবে। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পরিবর্তে দুনিয়াবী কোনো উদ্দেশ্যে তা করবে, তাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম একজন দানশীলকে বিচারের জন্য আল্লাহর নিকট হাজির করা হবে। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন, দুনিয়াতে এতো নিয়ামত পেয়ে তুমি সেখানে কী আমল করেছিলে? উত্তরে সে বলবে, যেসব ক্ষেত্রে ধন-সম্পদ ব্যয় করলে তুমি সন্তুষ্ট হবে, তোমার সন্তুষ্টির জন্য সেসব খাতের একটি পথেও ব্যয় করতে ছাড়িনি।
তখন আল্লাহ বলবেন,
كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ فَعَلْتَ لِيُقَالَ جَوَادٌ فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى فَأُلْقِيَ فِي النَّارِ
তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি এ জন্য দান করেছিলে, যাতে লোকেরা তোমাকে অধিক দানশীল বলে। আর তোমাকে দুনিয়াতে তা বলাও হয়েছে। অতঃপর তাকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেওয়া হবে।"
ইবাদতে আল্লাহর সন্তুষ্টির পরিবর্তে "রিয়া" বা লোক দেখানোর জন্য করার কারণে জান্নাত প্রাপ্তির পরিবর্তে জাহান্নামী হওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। রাসূল (স.) বলেছেন, 'রিয়া' এক প্রকার শিরক। এটি 'শিরকে খফী' তথা গোপন শিরক।
'রিয়া' তথা লোক দেখানো ইবাদাতের ভয়াবহতা সম্পর্কে আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, "দাজ্জালের চেয়েও যে বিষয় আমি তোমাদের জন্য বেশি ভয় পাই, সে বিষয়টি কি তোমাদেরকে বলব না?" আমরা বললাম, হ্যাঁ, নিশ্চয় বলুন, তখন রাসূলুল্লাহ (স.) বললেন, "গোপন শিরক। একজন লোক সালাতে দাঁড়াবে এরপর যখন দেখবে যে মানুষ তার দিকে তাকাচ্ছে তখন সে সালাত সুন্দর করে আদায় করবে।"
সাত. নির্জনে আল্লাহর ভয়ে চোখের পানি ফেলে
রাসূল (স.) বলেছেন,
وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللهَ خَالِيَّا، فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ
"যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার দু'চোখের অশ্রু ঝরায়।"
মানুষের দৃষ্টির আড়ালে নিরবে নির্জনে যিকির করার মাধ্যমে লৌকিকতা পরিহার করে ইখলাস তথা একনিষ্ঠতা অর্জন খুবই সহজ। মহান আল্লাহকে অধিকতর নিকটে পাওয়া যায়। সকল মানুষ যখন নিদ্রায় মগ্ন থাকে তখন নির্জনে আল্লাহ'র ইবাদতে মশগুল থাকাকে বিভিন্ন হাদীসে জান্নাত লাভের অন্যতম পাথেয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ জন্য উলামায়ে কেরাম নফল ইবাদত একাকী নির্জনে করার প্রতি উৎসাহিত করেছেন।
সার্বক্ষণিক মহান আল্লাহকে স্মরণ করার নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে,
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا اللهَ ذِكْرًا كَثِيرًا وَسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا
"হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে বেশি করে স্মরণ করো এবং সকাল সন্ধ্যায় তাঁর মহিমা ঘোষণা করতে থাকো।"
জীবনের সর্বক্ষেত্রে ও সর্বাবস্থায় আল্লাহর যিকির বা স্মরণ করা মুমিনের কর্তব্য। সকল প্রকার ইবাদতেই যিকির রয়েছে। সকল কাজই মূলত আল্লাহর নামেই শুরু করতে হয়। তবেই তাতে বরকত আসে। পাশাপাশি প্রতিটি কাজেই আল্লাহকে স্মরণ করা উচিত এভাবে যে, কাজটি মহান আল্লাহ হালাল করেছেন না কি হারাম করেছেন, সকল কাজে এই অনুভূতি জাগ্রত করাই প্রকৃত যিকির।
আমরা বিভিন্নভাবে যিকির করতে পারি। যেমন-
১. আল-কুরআন তিলাওয়াত, শিক্ষা দান, এর গবেষণা ও বাস্তবায়ন করা।
২. মহান আল্লাহর নামসমূহ বারবার পাঠ করা।
৩. তাঁর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।
৪. তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা, পারস্পরিক তা আলোচনা করা ও শিক্ষা দেয়া।
৫. তাঁর নিয়ামতরাজির স্মরণ করা।
৬. তাঁর নিকট দু'আ ও ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং
৭. এ কথা স্মরণ রাখা যে, তিনি সর্বদা আমার সাথে আছেন।
হাদীসটির শিক্ষণীয় দিক
১. ইসলামে আদল বা ন্যায়পরায়ণতার গুরুত্ব অপরিসীম। রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে সমাজপতি, বিচারপতি, পরিবার প্রধান, পিতা, স্বামী এমনকি প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজ নিজ পরিসরে তা পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
২. ইবাদাত জীবনের সকল স্তরে গুরুত্বপূর্ণ হলেও যৌবন কালের ইবাদাতের মর্যাদা বেশি। কারণ এ সময়ে মানুষের প্রবৃত্তি দমন অন্য বয়সের তুলনায় কষ্টসাধ্য।
৩. মসজিদ আল্লাহর ঘর, সালাত আদায়ের স্থান। মু'মিনের অবস্থান যেখানেই হোক, যে কাজেই সে লিপ্ত থাকুক, তার অন্তর সর্বদা মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত থাকবে এবং মসজিদই হবে তার আত্মার ঠিকানা।
৪. মানবীয় ভালোবাসার অন্তরালে বিভিন্ন কারণ থাকে। বৈষয়িক, আর্থিক, জৈবিক ইত্যাদি। ইসলাম এ ভালোবাসার সম্পর্ককে আল্লাহর ভালোবাসার সাথে সম্পৃক্ত করেছে। ফলে ভালোবাসা ও বিচ্ছিন্ন হওয়া।
৫. আল্লাহর ইবাদাতের অংশে পরিণত হয়েছে। প্রতিকূল পরিবেশে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নিজের সম্ভ্রম বজায় রাখা সর্বোত্তম ইবাদত।
৬. সাদাকাহকে অনেকে দুনিয়ার সম্মান ও খ্যাতি অর্জনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে, যা এর মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে। ফলে প্রয়োজন দেখা দেয় গোপন দানের।
৭. মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য নির্জনতা সর্বোত্তম কৌশল এবং মু'মিনের চোখের পানি আল্লাহ্ তায়ালার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান ও প্রিয়। ৮. প্রতিটি মু'মিনের কিছু গোপন আমল থাকা প্রয়োজন, যেগুলো আল্লাহ ছাড়া কেউ জানবে না, সেগুলোতে লোক দেখানোর কোনো প্রবণতা স্পর্শ করবে না, আন্তরিকতা হবে কানায় কানায় পরিপূর্ণ। যে আমল তার জন্য আরশের ছায়াসহ পরকালীন সব সফলতা অর্জন সহজতর করবে।
মহান আল্লাহ সকলকে হাদীসটির ওপর পূর্ণ আমল করার তৌফিক দান করুন।
তথ্য সুত্রঃ তাদরীসুল হাদীসঃ সিরিজ ০৩ (হাশরের মাঠে যারা আরশের ছায়া প্রাপ্ত হবে) প্রফেসর ড. মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম; ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।